সুগন্ধি বিশিষ্ট এক ধরনের কাঠ যা সারা বিশ্বে আগর গাছ নামে পরিচিত। আজ কিভাবে আপনি গড়ে তুলতে পারবেন এই আগর গাছের বাগান। আর আই আগর শিল্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে।
আগর বাগান |
আগর গাছের পরিচিতি:
আগর মূলত একটি গাছের নাম। আগর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধি বিশিষ্ট কাঠ। ইংরেজিতে এর নাম এলো ওড (Aloe Wood বা Wagle Wood), আরবিতে বলে উদ, দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত নাম গাডরউদ, মালয়েশিয়ান ভাষায় গাহারু বলে পরিচিত ও সমাদৃত। বাংলা, আরবি এবং ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে অপভ্রংশ হয়ে আগর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। পৃথিবীতে কবে কোথায় আগর-আতরের চাষাবাদ শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস বের করা মুশকিল। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রেইন ফরেস্টই আগর গাছের আদিস্থান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আগর গাছ থেকে বিশেষ কালো রঙের কাঠ পাওয়া যায়, যা আগর কাঠ নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় যা ‘মাল’ বলে অভিহিত করা হয়। স্থানীয়ভাবে যারা আগর কাঠ শনাক্ত করেন তাদের ‘দৌড়াল’ বলা হয়।
বাংলাদেশে মূলত Aquilaria agallucha, Aquilaria malaccenesis এবং Aquilaria malaccenesis প্রজাতির আগর গাছ চাষ হয়। ট্যাক্সোনোমিকেলি আগর গাছ Thymelaeaceae পরিবারের অন্তর্গত। আগর গাছ লম্বায় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিটার এবং বেড় বা ব্যাস ০.৬-২.৫ মিটার হয়। শাখা-প্রশাখবিহীন সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। এ গাছে সাদা রঙের ফুল এবং ফলগুলো ক্যাপসুল আকৃতির হয়। আগর গাছের পাতা দেখতে অনেকটা লিচু গাছের পাতার মতো, অনেকে বকুল গাছের পাতার সাথেও মিলাতে পারেন। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। ফলে আতর উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ গাছ ব্যবহার হয় না।
আগর-আতরের ব্যবহার:
আগরের সুগন্ধ প্রশান্তিদায়ক, অনেকেই শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগে। নানাবিধ ওষুধ, পারফিউম, পারফিউম জাতীয় দ্রব্যাদি-সাবান, শ্যাম্পু এসব প্রস্তুতে আগর তেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গৃহে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সুগন্ধি ছড়ানোর জন্য আগর-আতর ব্যবহার করা হয়। আগর আতরের পাশাপাশি আগর কাঠের গুঁড়া বা পাউডার ধূপের মতো প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মালম্বী সবাই আগর আতর ও আগর কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে। আতর বাংলাদেশে তরল সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আগর গাছের উৎপাদন কৌশল:
বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, পতিত জমি, টিলার ঢালে, টিলা বা পাহাড়ে এমনকি পরিত্যক্ত জায়গায় আগর গাছ লাগানো যায়। পাহাড় বা টিলা জমিতে আগর গাছ ভালো জন্মে। তবে সব জমিতেই কমবেশি জন্মে।
চারা তৈরিঃ
গাঢ় বাদামি বর্ণের ৩.৮১ সেমি.-৫.০০ সেমি (১.৫-২ ইঞ্চি) লম্বা ক্যাপসুল জাতীয় ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি ফলে দুটো বীজ হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকে। সাধারণত ৭-১০ দিন পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা স্থায়ী থাকে। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বীজ বপনের উৎকৃষ্ট সময় মার্চ-এপ্রিল। চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। প্রথমে বালুর বেডে বীজগুলো বিছিয়ে দিয়ে ওপরে আবারও বালু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এখানে বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়। প্রায় ২০-২৫ দিন পরে পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরিত হয়। চারা গজানোর জন্য অস্থায়ী শেডের ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। চারায় নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
চারা রোপণঃ
বর্ষা মৌসুম আগর গাছের চারা রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। বাংলাদেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আগরের চারা রোপণ করলে গাছ টিকে বেশি। স্কুল, কলেজ, রাস্তা দুই পাশেও আগরের চারা রোপণ করা যায়। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতেও আগর গাছ লাগানো যেতে পারে। রোপণের সময় প্রতিটি গর্তে জৈব সার-কম্পোস্ট সার, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম সার গাছের বয়স অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫২ মি.-১.৮২ মি. (৫-৬ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৯১.৪৪ সে.মি.-১.২২ মি. (৩-৪ ফুট) বজায় রাখা উত্তম। সাধারণত ১-২ বছর বয়সী আগরের চারা লাগানো হয়। একক বাগানের ক্ষেত্রে কম দূরত্ব এবং মিশ্র বাগানের ক্ষেত্রে একটু বেশি দূরত্ব রাখা উচিত। অন্যান্য গাছের মতো চারা রোপণের পূর্বে দৈর্ঘ্যে ৫০ সেমি প্রস্থে ৫০ সেমি এবং গভীরতায় ৫০ সেমি আকারের গর্ত তৈরি করে পচা গোবর ও সার প্রয়োগ করা ভালো।
আগর গাছের চাষ পদ্ধতি |
আগর গাছের সাথে আন্তঃফসলঃ
সাধারণত প্রথম ৩-৫ বছর পর্যন্ত মিশ্র ফসল যেমন শাকসবজি ও ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যায়। পরবর্তীতে কয়েক বছর ছায়া পছন্দকারী সর্পগন্ধা ঔষধি গাছের আবাদ করা যায়। আদা এবং হলুদও চাষ করা হয়। তাছাড়া সুপারি, কফি, রাবার, পামগাছসহ অধিকাংশ বনজ গাছ আগর গাছের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। বিভিন্ন দেশে এলাচও চাষ করে।
আন্তঃপরিচর্যাঃ
খরা মৌসুমে পানি সেচ দিতে হয়। প্রয়োজনমতো আগাছা দমন করতে হবে। তাছাড়া নিয়ম করে কিছু রাসায়নিক সার দিলে গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। এক্ষেত্রে নতুন আগর গাছের বাগানে কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয় না। আগর গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সার ব্যবহার করা যায়। একবার বর্ষার আগে এবং একবার বর্ষার পরে অর্থাৎ বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করা উত্তম।
আগরের রোগ-বালাইঃ
আগরের তেমন কোনো রোগ হয় না তবে মাঝে মাঝে গোড়া পচা রোগ এবং ডাইব্যাক রোগে গাছের ডালপালা শুকিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। আগর চাষের ক্ষেত্রে বিছা পোকা পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করে বিছা পোকার আক্রমণ দমানো যায়।
আরও পড়ুন - মরিচ গাছের যত্ন নেওয়ার নিয়ম
আগর সংগ্রহের সময়ঃ
প্রাকৃতিকভাবে আগর গাছে আগর তৈরি হতে ২৫-৩০ বছর সময় লেগে যায়। তবে কৃত্রিমভাবে ৫-৬ বছর বয়সী আগর গাছে পেরেক মেরে এসব গাছ ১৫-১৬ বছর হলেই আগর কাঠ সংগ্রহ করা যায়। আগর কাঠ সংগ্রহের জন্য গাছ কর্তনের উপযোগী হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করা হয় মূলত গাছ কতটুকু রুগ্ন হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। গাছের বয়স, গাছের বৃদ্ধি ও শারীরতাত্ত্বীয় পরিপক্বতা বিবেচনা করে আগর গাছ কর্তন করা হয় না বরং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া, দৃশ্যমান ক্ষতযুক্ত কাণ্ড, কাঠের বিকৃতি, ক্ষুদ্র পাতা, মূল কাণ্ড ও শাখার ওপর মরা লক্ষণ এসব দেখে আগর কাঠ কর্তন করা ও সংগ্রহ করা হয়। সারা বছরই আগর কাঠ সংগ্রহ করা গেলেও জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসই আগর কাঠ সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় গাছ সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে আগর কাঠে আতর বা তেলের পরিমাণ বেশি ও গুণগত মানের পাওয়া যায়। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গাছ থেকে ২.০-২.৫ কেজি পরিমাণ আগর কাঠ পাওয়া যায়।