২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতার।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপ। কারণ এই বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতার ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। অতীতে সর্বোচ্চ অর্থ খরচ করা হয়েছিল ব্রাজিল বিশ্বকাপে। তখন খরচ হয়েছিল মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার। এবারই প্রথম কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আরব দেশ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এটি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ আয়োজন। এর আগে ২০২২ সালে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়া মহাদেশের প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল।
বিশ্বকাপ আয়োজন করা দেশগুলোর মধ্যে কাতারই সবচেয়ে ছোট দেশ । এর আগে সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল সুইজারল্যান্ড। এ বিশ্বকাপ আরেকটি কারণে বিশেষ আর তা হলো ৩২ টি দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত বিশ্বকাপের শেষ আসর বসবে কাতারে। ২০২৬ সালে এর পরবর্তী বিশ্বকাপে ৪৮ টি দল অংশগ্রহণ করবে।সেই আসর আয়োজন করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো এবং কানাডা। বিশ্বকাপ সাধারণত জুন-জুলাই মাসে আয়োজন করা হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকালে কাতার উপদ্বীপের তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস সে কারণে বিশ্বকাপের আসর নভেম্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে বিচারে এটি প্রথম বিশ্বকাপ শীতকালে আয়োজন করা হচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপ শুরু হবে ২১শে নভেম্বর শেষ হবে ১৮ই ডিসেম্বর। কাতারের পাঁচটি শহরের আটটি মাঠে এই আসরের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য কাতার অনেকগুলো নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে এবং কাতারে থাকা পুরনো স্টেডিয়ামগুলো কেও ভেঙে আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বারটি স্টেডিয়াম প্রস্তুত করার কথা ছিল কাতারের। কিন্তু পরবর্তীতে অত্যধিক খরচের কথা বিবেচনা করে তারা আটটি স্টেডিয়াম সাজানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চোখ ধাঁধানো সেই আটটি স্টেডিয়াম সম্পর্কে আলোচনা করা হবে আজকের লেখায়।
লুসাইল স্টেডিয়াম:
কাতারের লুসাইলে অবস্থিত লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম
একটি অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামের প্রায় ৮০হাজার দর্শক একসাথে বসে খেলা
উপভোগ করতে পারবেন। এখানে ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে। ব্রিটিশ
সংস্থা ফস্টার প্লাস পার্টনারস স্টেডিয়ামটি নকশা করেছে। এই স্টেডিয়ামের নকশা অনুপ্রেরণা
নেওয়া হয়েছে কাতারের ঐতিহ্যবাহী খেজুর রাখার পাত্র বা খেজুরের বাটি থেকে এবং এর উপর
ইসলামী কারুকার্য প্রতিফলন ঘটেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে স্টেডিয়ামটি শূন্যে ভাসমান
অবস্থায় রয়েছে। স্টেডিয়ামে প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এই স্টেডিয়ামের ছাদ খোলা এবং বন্ধ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।ছাদ বন্ধ অবস্থায় স্টেডিয়ামকে
সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা যাবে। কাতারের রাজধানী দোহায় থেকে সরাসরি সড়কপথে
যোগাযোগের জন্য স্টেডিয়াম পর্যন্ত একটি মেট্রো রেল লাইন বসানো হয়েছে। সমগ্র স্টেডিয়ামটি
চলবে সৌরশক্তিতে। বিশ্বকাপের পরে স্টেডিয়ামটির ৪০০০০ আসনে পুনর্গঠিত করা হবে। অতিরিক্ত
আসন সরিয়ে বিল্ডিংয়ের অন্যান্য অংশ দোকান, ক্যাফে, অ্যাথলেটিক ও শিক্ষার সুযোগ সুবিধা
এবং একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
আলবাইক স্টেডিয়াম:
কাতার আড় খোড় এলাকায় অবস্থিত আলবাইক স্টেডিয়াম।
এই স্টেডিয়ামে প্রায় 60 হাজার দর্শক একসাথে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবে। এছাড়া সংবাদ
কর্মীদের জন্য আরও ১০০০ আসন রয়েছে। স্টেডিয়ামটির
নির্মাণশৈলী এবং পরিবেশবান্ধব ডিজাইনের কারণে স্থাপনাটি বিশেষ স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
মজার ব্যাপার হলো এই স্টেডিয়ামের ভেতরেই আছে আবাসিক হোটেল। সেই হোটেল রুমের বারান্দা
থেকে সরাসরি মাঠের ফুটবল খেলা উপভোগ করা যাবে। স্টেডিয়ামটিতে পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে
বহু জায়গা। এখানকার পার্কিংয়ে একসাথে ৬ হাজার গাড়ি , ১০০০ ট্যাক্সি, ৭০০ টি বাস
এবং অনেকগুলো ওয়াটার ট্যাক্সি রাখা যাবে। স্টেডিয়ামে প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি সেতু
নির্মাণ করা হয়েছে।
স্টেডিয়াম 974:
স্টেডিয়াম 974 এর পূর্ব নাম ছিল রাজা
আবু আবুদ স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামের ধারন ক্ষমতা প্রায় ৪০০০০ স্টেডিয়ামটি কাতার
বিশ্বকাপের অন্যতম চমক। কারণ এটি এক ধরনের পরিবর্তন যোগ্য বা পরিবহনযোগ্য স্টেডিয়াম
স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের নকশায় শিপিং কন্টেনারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর নাম
974 রাখার কারণ হলো কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়াল কোড +974। শুধু তাই নয় এই স্টেডিয়াম নির্মাণের ৯৭৪টি
শিপিং কনটেইনার ব্যবহার করা হয়েছে।স্টেডিয়াম 974 ডিজাইন করেছে স্পেনের স্থাপত্য বিষয়ক
সংস্থা ফেনউইক ইরিবারেন্ট আর্কিটেক্টস। বিশ্বকাপ
শেষ হবার পর কাতারের এতগুলো স্টেডিয়ামের কোন দরকার নেই। তাই বিশ্বকাপের পর এই স্টেডিয়াম
খুলে এর নির্মান সামগ্রী দিয়ে অন্য জায়গায় আবার নতুন স্টেডিয়াম বা ক্রিয়া অবকাঠামো তৈরি করা হবে। প্রয়োজনীয় স্টেডিয়ামের
অংশগুলোকে জাহাজে করে অন্যদেশেও নিয়ে যাওয়া যাবে। সে কারণেই একে বলা হচ্ছে বিশ্বের
সর্বপ্রথম পরিবহনযোগ্য স্টেডিয়াম। কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে স্টেডিয়ামটি কোন
অনুন্নত দেশে দান করা হবে। যারা এটা ব্যবহার করে তাদের ফুটবল উন্নয়নে কাজে লাগাতে
পারবে।
আল সুমামাহ স্টেডিয়াম:
আল সুমামাহ স্টেডিয়াম কাতারে আল সুমামাহ এলাকায় অবস্থিত একটি
অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে প্রায়
৪০ হাজার দর্শক একসাথে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবেন। এই মাঠে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার
ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে।স্টেডিয়ামের অবকাঠামো নকশা করা হয়েছে আরবের ঐতিহ্যবাহী
টুপির আদলে। স্টেডিয়ামটির নকশা তৈরি করেছেন আরব ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরোর ডিজাইনার ইব্রাহিম এম যাইদা । ২০২২ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার
পর স্টেডিয়ামের ধারন ক্ষমতাকে ২০ হাজারে কমিয়ে আনা হবে। অতিরিক্ত আসনগুলো বিদেশে
কোন ফুটবল প্রজেক্ট উন্নয়নের জন্য দান করা হবে।
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম:
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম কাতার আল রাইয়ানে অবস্থিত
এটি কাতার ফাউন্ডেশন এর এডুকেশন সিটির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত।
এই স্টেডিয়ামে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক একসাথে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবে। ফিফা বিশ্বকাপের
পরে স্টেডিয়ামটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিক দলগুলো ব্যবহার করবে। তখন স্টেডিয়ামের
ধারন ক্ষমতা কমে হবে ২৫০০০। এই স্টেডিয়ামটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশগত টেকসই স্টেডিয়াম
এর মধ্যে একটি। ২০১৯ সালের মে মাসে এডুকেশন সিটি পাঁচ তারকা জিএসএস রেটিং অর্জন করেছে। স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ ২০২০ সালের জুন মাসের সম্পন্ন হয়েছে এবং ২০২০ সালের
১৫ ই জুন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে।
আল রাইয়ান স্টেডিয়াম:
আল রাইয়ান স্টেডিয়ামের পূর্ব নাম ছিল আহমদ বিন
আলী স্টেডিয়াম। বর্তমানে এটি আল রাইয়ান স্টেডিয়াম নামেই পরিচিত। এই স্টেডিয়ামটি
হচ্ছে কাতার স্টার্স লিগের দল আল রাইয়ান স্পোর্টস ক্লাব এর ঘরোয়া মাঠ। ২০০৩ সালে
এই মাঠ যখন আহমদ বিন আলী স্টেডিয়াম নামে ছিল তখন এর ধারন ক্ষমতা ছিল ২১ হাজারের কিছু
বেশি। ২০২২ বিশ্বকাপ উপলক্ষে মাঠটিকে সংস্কার করে প্রায় ৪১ হাজার ধারণক্ষমতা উন্নীত করা হয়েছে। নতুন স্টেডিয়ামের
নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে 2016 সালে। পরিবেশ বান্ধব ও স্থায়িত্বের দিকটি বিবেচনায়
রেখে স্টেডিয়ামটি তৈরি করা হয়েছে। কাতারের সংস্কৃতির প্রতীক এবং কাতারের
মরুময়
বালির কাঠামো প্রতিফলিত হবে আল রাইয়ান স্টেডিয়ামের নকশায়। এই মাঠে বিশ্বকাপের মোট
সাতটি খেলা অনুষ্ঠিত হবে। ২০২২ বিশ্বকাপে প্রতিযোগিতার পর স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতাকে আবারো ২০০০০ কমিয়ে আনা হবে। অতিরিক্ত
আসনগুলো বিদেশে কোন ফুটবল প্রজেক্ট উন্নয়নের জন্য দান করা হবে।
খলিফা
আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম: খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম কাতারের জাতীয় স্টেডিয়াম।
কাতারের দোহায় অবস্থিত এই মাটি বহুমুখী স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দোহা স্পোর্টস
সিটির অংশ। স্টেডিয়ামটি কাতারের সাবেক আমীর খলিফা বিন হামাদ আল থানি নামে নামকরণ করা
হয়েছে। এই সেস্টেডিয়ামটি ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম চালু করা হয়েছিল। এটি কাতার জাতীয়
ফুটবল দলের ঘরোয়া স্টেডিয়াম। ২০০৬ সালের এশিয়ান গেমসের সময় এই স্টেডিয়ামের ধারনক্ষমতা
২০ হাজার থেকে ৪০ হাজারের উন্নিত করা হয়েছিল।
এই স্টেডিয়ামে ২০১১ সালের এফসি এশিয়া কাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে পুনর্নির্মাণের
পর ২০১৭ সালে আবারও নতুন করে স্টেডিয়ামটি
উদ্বোধন করা হয়। কাতার ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্টেডিয়ামটির ধারন ক্ষমতা বাড়িয়ে ৬৮০০০ করার পরিকল্পনা করা
হয়েছে। ২০২২ বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজন করা স্টেডিয়াম গুলোর মধ্যে এই স্টেডিয়ামটির
কাজ সর্বপ্রথম শেষ হয়েছে।
আল
জানুব স্টেডিয়াম: আল জানুব স্টেডিয়ামের পূর্ব
নাম ছিল আল ওয়াকার স্টেডিয়াম। এটি কাতার আলওয়াকরা শহরে অবস্থিত। স্টেডিয়ামটি ২০১৯
সালেও উদ্বোধন করা হয়েছে। বিখ্যাত স্থপতি জাহা হাদিদ এই স্টেডিয়ামের নকশা করেছেন।
২০২২ বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম আটটি স্টেডিয়ামের
মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এই আল জানুব স্টেডিয়াম। পারস্য উপসাগরের মুক্তার শিকারিদের
ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী দাউ নৌকার পাল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই স্টেডিয়ামের ছাদের নকশা
করা হয়েছে। এই স্টেডিয়ামের ছাদ ইচ্ছা মতো সরানো যায়। বিশেষ শীতলীকরণ ব্যাবস্থা থাকার
কারণে স্টেডিয়ামের ভিতর অতিরিক্ত গরম হয় না এতে দর্শকদের গ্যালারি ১৮ ° সেলসিয়াস
এবং খেলার মাঠ ২০°সেলসিয়াসে ঠান্ডা রাখা যায়।বর্তমানে এই স্টেডিয়ামের ধারণ ক্ষমতা
৪০ হাজার। বিশ্বকাপের পরেও এই স্টেডিয়ামের আসন কমিয়ে ২০০০০ করা হবে এবং বাকি অর্ধেক
আসন উন্নয়নশীল দেশে গুলোতে অনুদান করা হবে।
কাতার
বর্তমান পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর একটি। সেই কারণে তারা একটি বিশ্বকাপ উপলক্ষে ২২০ বিলিয়ন
ডলার খরচ করছে। অথচ এই বিশ্বকাপ থেকে তারা মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। বর্তমানে
তাদের এত বিপুল অর্থ অপচয় করার সামর্থ্য থাকলে
অতীতে কাতার ছিল চরম দরিদ্র এক দেশ।
শুধু তাই নয় পৃথিবীর শীর্ষ বসবাসের অযোগ্য স্থান গুলোর মধ্যে কাতার ছিল অন্যতম। ১৯৭১
সালে কাতার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। মাত্র ৫০বছরে ব্যাবধানে বসবাসের
অযোগ্য মরুভূমি থেকে কাতার ধনী রাষ্ট্রে পরিণত।