বর্তমানে আমরা মনরঞ্জনের জন্য টিভি দেখি কিন্তু আজ থেকে কয়েক দশক আগে যখন টিভির প্রচলন এত বেশি ছিল না, তখন কিন্তু আমাদের মনরঞ্জনের একটা উৎস ছিল রেডিও। খবর, গান বা কোন নাটক এগুল শোনার জন্য রেডিও সেই সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখনকার দিনে গ্রামের মানুষরা এক জোট হয়ে এই রেডিও প্রগ্রাম শুনত। তবে মাঝে টিভি আর স্মার্টফোন আসার পর রেডিও ব্যাবহার কিছু কমে গেলেও বর্তমানে স্মার্ট ফোন এমনকি গাড়িতেও রেডিওর ব্যবস্থা আছে। যার ফলে একশো বছর পার হয়ে গেলেও রেডিও নিয়ে মানুষের আবেগ সেই একইরকম রয়ে গেছে। কিন্তু আপনি কি জানেন এই রেডিও কে কবে এবং কিভাবে আবিষ্কার করেছিলেন ?
আজকের লেখায় রেডিও আবিষ্কারের আশ্চর্য ইতিহাস আপনাদের জানাব। তাই লেখাটি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
বন্ধুরা পৃথিবীর কোন জিনিসের আবিস্কার একদিনে বা একজনের দ্বারা হয়নি। প্রতিটা আবিস্কারের পেছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানী নিরলস পরিশ্রম। রেডিও আবিষ্কারও একদিনে হয়নি। রেডিওর মাধ্যমে যে পদ্ধতিতে বর্তা পাঠানো হয় তাকে বলা হয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। এটি এক ধরনের চুম্বকীয় তরঙ্গ খুব সহজেই কোন বস্তুকে ভেদ করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে। ১৮৮০ সালে বিজ্ঞানী হেনরি রুডল ফারডস্ প্রথম বার এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ আবিষ্কার করেন। যা ছিল রেডিও অনেক আবিস্কারের দিকে প্রথম সফল পদক্ষেপ। ফারডস্ লক্ষ্য করেন এই তরঙ্গ বিভিন্ন বস্তুকে ভেদ করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব সহজেই চলে যেতে পারে। তখন তিনি ভাবেন যদি কোনো উপায়েই এই তরঙ্গের মাধ্যমে কোন বার্তা প্রেরণ করা যায় এবং সেই বার্তাকে রিসিভ করা যায় তাহলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঐক বিপ্লবের সূচনা হবে। রুডল ফারডস্ তখন রেডিও আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করে দেন।
দুর্ভাগ্যবশত তিনি তার আবিষ্কারকে বেশি দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। তাই মৃত্যু পর তার সহযোগী বিজ্ঞানীরা রুডল এর আবিস্কৃত চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং রেডিও আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা নিয়ে একটি বই বের করেন। যাতে পরবর্তীকালে যেসব বিজ্ঞাপক্ষের চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ করবেন তাদের যাতে অসুবিধা না হয়। এরপর ভারতের একজন মহান বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রুডলের আবিষ্কৃত চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার আবিস্কারের লক্ষ্যে ছিল কীভাবে এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভকে কাজে লাগানো যায়। কিছুদিন পর ১৮৯০ সালে জগদীশচন্দ্র বসু একটি বিজ্ঞানের প্রদর্শনীতে এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের সাহায্যে কিছুটা দূরে থাকা একটি যন্ত্র যার মধ্যে একটি ঘন্টা ছিল তা তিনি বাজিয়ে দেখান। আর এটা বিজ্ঞানীমহলে সেই সময় যথেষ্ট আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল কারণ কোন তারের সংযোগ ছাড়া এভাবে এভাবে সংকেত পাঠানো যেতে পারে তা একেবারে কল্পনার অতীত ছিল। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তার এই আবিস্কারকে আরো উন্নত মানের বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যান।
অন্যদিকে আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী যার নাম ছিল গুগলিয়ামি মার্কনি তিনিও এই ইলেক্ট্রম্যাগনেটিক ওয়েভ অর্থাৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। তার আবিষ্কারের উদ্দেশ্য ছিল এই তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বার্তা প্রেরণ করা। একদিন মার্কনি যখন তার ল্যাবরেটরীতে কাজ করছিলেন তখন তিনি তার পাশে থাকা একটি যন্ত্র প্রেস করতে দূরে থাকা একটি যন্ত্র বেজে ওঠে । এরপর মার্কনি এই যন্ত্রটিকে আরও আপডেট করেন। এরপর তিনি একদিন একটি ছোট পাহাড়ের কাছে যান তাঁর এই যন্ত্রটি নিয়ে পহাড়ে এক পাশে তিনি ছিলেন অন্য পাশে ছিল তার ভাই। মার্কনি যখন রেডিও যন্ত্রের মাধ্যমে পাহাড়ের এপাশ থেকে সিগন্যাল পাঠান তখন অন্য পাশ থেকে তার ভাই রিসিভারে মাধ্যমে রিসিভ করে নেয়। এটা দেখে তারা খুব খুশি হয়ে যান। এরপর থেকে মার্কনি তার এই বেতার যন্ত্র দিয়ে জন্য বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নিয়ে যান। আর তার আবিষ্কার দেখে সবাই অবাক হয়ে যান।
এই আবিষ্কার সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য প্রস্তুত করা হয়নি । ১৮৯৭ সালে মার্কনি প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে এই সংকেত পাঠান। আর ১৯০১ সালে তিনি তার এই যন্ত্রের মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগর পাড় করে আমেরিকায় রেডিওর মাধ্যমে তথ্য পাঠান। গোটা ইউরোপে জুড়ে তখন মার্কনির জয়জয়কার হচ্ছিল। আর ১৯০৯ সালে মার্কনি তার রেডিও যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তবে মার্কনির আবিষ্কারের একটি সমস্যা ছিল। কারণ এই যন্ত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি রিসিভারে মানে একজন ব্যক্তির কাছে তথ্য পাঠানো যেত। এই সমস্যার সমাধান বের করেন একজন কানাডিয়ান বিজ্ঞানী রেজনাল ফিসিনডেন। তিনি মার্কিনর এই রেডিওকে আর উন্নত মানের তৈরি করেন। এরপর তিনি ১৯০৬ সালে ২৪শে সেপ্টেম্বর এই রেডিওয়ের সামনে বসে বেহালা বাজান আর তার তৈরি যন্ত্রের মাধ্যমে সেই সময় আটলান্টিক মহাসাগরে থাকা সমস্ত জাহাজের রেডিওতে সেই বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শোনা যায়। আর এইটা ছিল পৃথিবীতে হওয়া প্রথম রেডিও ব্রডকাস্ট। একের অধিক ব্যাক্তিরা একই সময় শুনতে পেয়েছিলেন।
তবে রেডিও তখনও সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহার করা হতো না। কারণ রেডিও তখন বেশিরভাগ ব্যবহার করা হতো নৌসেনাদের জন্য বা গভীর সমুদ্রে থাকে জাহাজের জন্য। এখানে আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি ১৯১২ সালে টাইটানিক দূর্ঘটনায় সময় এই রেডিওএর মাধ্যমেই কাছে থাকার কারফিতিয়া জাহাজে সংকেত পাঠানো হয়েছিল। যার কারণে বহু মানুষের জীবন বেঁচে গিয়েছিল। আর শুধুমাত্র টাইটানিক নয় সেই সময় দুর্ঘটনার হাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে রেডিও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন সেনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠানোর জন্য রেডিও ব্যবহার করা হতো। সেই সময় রাতে সংকেত পাঠাতে কোন রকম অসুবিধা না হয় এই কারণে সাধারণ নাগরিকদের রেডিও ব্যবহারের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ গেলে ১৯২০ সালে একজন প্রাক্তন আমেরিকার নেভি অফিসার প্রাঙ্ককোনাড বিশ্বের প্রথম রেডিও স্টেশন স্থাপন করেন। এরপর থেকে রেডিও সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুরুর দিকে যদি কোন ব্যক্তি তার তার বাড়িতে রেডিও রাখতে চাইতো তবে তার থেকে ১০ পাউন্ডের ট্যাক্স নেওয়া হতো।
পরে এই রেডিও এর ব্যবহার বাড়তে থাকলে এই ট্যাক্স তুলে নেওয়া হয়। ভারতে সর্বপ্রথম রেডিও আসে ১৯২৪ সালে। সেই সময় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম রেডিও নিয়ে আসা হয়। ১৯২৭ সালে কিছু ব্যবসায়ী মিলে একটি রেডিও স্টেশনের স্থাপনা করেন । বোম্বে এবং কলকাতায় রেডিও ব্রডকাস্ট শুরু করে দেয়। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার এই কোম্পানিকে নিজেদের দখলে করে নেয় আর তখন সেই কোম্পানির নাম রাখা হয় ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস।১৯৩৭ সালে আবার নাম বদলে রাখা হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও যা স্বাধীনতার পরে আকাশবাণী নামে পরিচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে রেডিও মাধ্যমের হওয়া প্রচার একটি রাষ্ট্রীয় সেবা মধ্যে ধরা হয়। আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি রেডিও ভারতের স্বাধীনতা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গান্ধীজীর এই রেডিও এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে ভারতছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। বর্তমানে এই রেডিও ওয়েভকে কাজে লাগিয়ে বহু উন্নত মানের যোগাযোগের যন্ত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ফলে মানুষের জীবন আরো সহজ হয়ে গেছে ।