ইলেক্ট্রিসিটি এমন একটি জিনিস যা মূলত সব ধরণের অর্থের মূল উৎস। আপনি একটি মোবাইল ব্যবহার করছেন সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার হচ্ছে, আপনি শস্য উৎপাদন করতে যান সেখানেও ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবহার রয়েছে, অফিস আদালত, কলকারখানা কিংবা আমাদের যত ধরণের যান্ত্রিক জীবন রয়েছে তার সবকিছুতেই ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবহার রয়েছে। ইনফ্যাক্ট ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবহার ছাড়া ব্যাংক কিংবা ডিজিটাল কারেন্সি কোনো কিছুই চলা সম্ভব নয়। তাই আপনি যেদিক থেকেই তাকান ইলেক্ট্রিসিটি বর্তমান সময়ে এমন এক জিনিস যেটাকে কোনোভাবে কোনো অর্থে অগ্রাহ্য করার কোনো অপশন পৃথিবীর কোনো দেশেই তৈরি হয়নি। মানবজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাকৃতিক যে উৎস রয়েছে সেটা খুবই সামান্য। সবমিলিয়ে পৃথিবীর দশ থেকে বার শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে কয়লা, গ্যাস এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি, কিভাবে উৎপন্ন হয় এবং এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কি কি এলিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে তার সবকিছু উঠে আসবে আমাদের আজকের লেখাটিতে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র |
পারমাণবিক বিদ্যুৎ মূলত পারমাণবিক শক্তিকে বিশেষ কৌশলে ব্যবহার করে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সেটির পরমাণু বিদ্যুৎ। আমরা জলবিদ্যুৎ, কয়লাবিদ্যুৎ, গ্যাসবিদ্যুৎ কিংবা সোলার এনার্জির মতো গ্রীন এনার্জি যত কিছু আছে সবকিছু সম্পর্কেই মোটামুটি কম বেশি জানি। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ব্যাপার কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াটা প্রায় একইরকম। অন্যান্য সব বিদ্যুৎ উৎপাদন এ যেমন জেনারেটর, ট্রান্সফরমার এবং টারবাইন এর ব্যবহার হয়, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সেসব কিছুর ব্যবহার রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম। ইউরেনিয়াম এর মত আরো দুইটি এলিমেন্ট রয়েছে যেগুলো হচ্ছে প্লুটোনিয়াম এবং থোরিয়াম। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ (235U) ব্যবহার করা হয়। ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ এর মৌল গুলোর আকার একটু বড়। ইউরেনিয়াম 235 (235U) এর মৌলটাকে যদি কোনো নিউট্রন এসে আঘাত করে তবে সেটি ভেঙে নতুন দুটি নিউক্লিয়াসের মৌল তৈরি করবে। পদার্থ বিজ্ঞান এর ভাষায় বড় একটি ইউরেনিয়াম এর মৌল ভেঙে ছোট দুটি নিউক্লিয়ার মৌলে পরিণত করার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন। একইভাবে যেই নিউট্রন আঘাত করেছিল সেই নিউট্রন নিজেও ভেঙে দুটি নিউট্রন এ বিভক্ত হয়ে যায়। বিভক্ত হয়ে যাওয়া নিউট্রন এবং নিউক্লিয়াস মৌল গুলোকে যদি যুক্ত করা হয় তবে ইউরেনিয়াম এর ভরের পরিমাণ টা পূর্বের সমান হওয়ার কথা কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্নরকম।
নিউক্লিয়াসের ভরের এই পরিমাণ টা পূর্বের চেয়ে কিছুটা কম হয়ে গিয়েছে। তার মানে কিছুটা নিউট্রন এবং নিউক্লিয়াস এখান থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া সেই ভরটাই মূলত হচ্ছে আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী শক্তি যেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘোরানো হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাই দা ওয়ে, আইনস্টাইনের সেই সূত্রটি হচ্ছে ই ইকোয়ালস টু এমসি স্কয়ার, E=MC2। সূত্রটির বিশাল একটি ব্যাখ্যা রয়েছে তাই এখানে বলা সম্ভব হচ্ছেনা। আপনি গুগল সার্চ করলে সেটা পেয়ে যাবেন এবং বুঝে নেবার চেষ্টা করবেন আশা করি। ইউরেনিয়াম এবং নিউট্রন এর আঘাতের এই পরিমাণ টা একইভাবে চলমান থাকে যতক্ষণ তারা এক জায়গায় থাকে এবং এটি একটি চেইন প্রক্রিয়া যেটি সমান্তরাল ধারায় নয় বরং গুনোত্তর ধারায় চলমান থাকে যার মানে মুহূর্তের মধ্যেই নিউট্রন এবং নিউক্লিয়াস গুলো লক্ষ লক্ষ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। গুনোত্তর ধারায় এভাবে অগ্রসর হওয়ার মানেই হচ্ছে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই এটি কল্পনাতীত শক্তির অধিকারী হয়ে যাবে যাকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে। অত্যন্ত তীব্র এই বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে প্রয়োজন শুধু নিউট্রন কে নিয়ন্ত্রণ করা কারণ মৌলগুলোকে ভেঙে শক্তি বাড়িয়ে তোলার কাজটা করে যাচ্ছে নিউট্রন আর বর্তমান পৃথিবীতে নিউট্রনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ক্যাডমিয়াম মৌল যেই ক্যাডমিয়াম অতিরিক্ত নিউট্রন কে শোষণ করতে সক্ষম। তাই নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের মাঝে যদি কিছু ক্যাডমিয়াম রড রেখে দেওয়া হয় তবে সেগুলো অতিরিক্ত নিউট্রন কে শোষণ করে নিতে পারে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ |
নিউট্রনকে শোষণ করে নেয়ার ফলে চেইন রিয়েকশন টা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। যেই ছবিটি দেখতে পাচ্ছেন এটি একটি পারমানবিক চুল্লির ভিতরের রডগুলো। এখানে মাঝের যে সাদা রডগুলো দেখতে পাচ্ছেন এগুলো মূলত নিউক্লিয়ার ফুয়েল রড যেই রডগুলোর ভিতরে রয়েছে ইউরেনিয়াম এবং নিউট্রন স্টিক। নিউক্লিয়ার ফুয়েল রডগুলোর চারপাশে কিছু লাল আকৃতির রড দেখা যাচ্ছে আর সেগুলো হচ্ছে ক্যাডমিয়াম রড। এখানে ক্যাডমিয়াম রডের পরিমাণ যত বেশি দেয়া হবে নিউট্রন এর নিয়ন্ত্রণ ততবেশি হয়ে যাবে। আবার ক্যাডমিয়াম রডের পরিমাণ যদি একদম কমিয়ে দেয়া হয় তবে নিউট্রনএর নিয়ন্ত্রণ অনেকবেশি হারিয়ে যাবে। চেইন রিয়েকশনে নিউট্রনএর নিয়ন্ত্রণ এর জন্যে ক্যাডমিয়াম রডের ব্যবহারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ক্যাডমিয়াম রডের পরিমাণ বেশি হলে শক্তি উৎপাদন কম হবে, ক্যাডমিয়াম রডের পরিমাণ কম হকে শক্তি উৎপাদন বেশি হবে। রাশিয়ার চারনোবিল এ যে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেটা মূলত ক্যাডমিয়াম রড ব্যবহার করে নিউট্রন এর চেইন রিয়েকশন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়াতেই হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এখান থেকে বিদ্যুৎ কিভাবে উৎপন্ন হয়?
আমরা যে পারমাণবিক চুল্লি চিনি সেই চুল্লির ভিতরে থাকে মূলত বেশ কিছু রড। সরু আকারের সেই রডগুলোর ভিতরে অন্তত ১০০-১২০টির মত নিউক্লিয়ার স্টিক থাকে। নিউক্লিয়ার এর স্টিকগুলোকেই বলা হয় নিউক্লিয়ার ফুয়েল। যে নিউক্লিয়ার স্টিকগুলোই মূলত হচ্ছে ইউরেনিয়াম এবং নিউট্রন। পাশাপাশি নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ক্যাডমিয়াম রড ও ব্যবহার করা হয়। নিউক্লিয়ার এই রড গুলোর বাইরে এখানে থাকে শুধু পানি। চুল্লির ভিতরে নিউক্লিয়ার রড গুলোর মধ্যে যখন বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় তখন প্রচন্ড আকারের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পানিতে। পারমাণবিক চুল্লির মুখটি পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র বা সিলড হওয়াতে পানিটা সেখানে বাষ্প এ পরিণত হতে পারেনা যা প্রেশারাইজড হয়ে পানি আকারেই থাকে। চুল্লির ভেতরের উত্তপ্ত সেই পানিটাকে প্রেশারাইজার এর মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয় স্টিম জেনারেটর এ। যেই স্টিম জেনারেটর বাষ্প তৈরি করছে। স্টিম জেনারেটর থেকে উৎপাদিত বাষ্প সরাসরি গিয়ে টারবাইন টাকে ঘুরাচ্ছে। সেখানে বাষ্প শক্তিটা এত বেশি যা সে টারবাইন টাকে প্রায় ৩৫০০ আরপিএম গতিতে ঘুরাচ্ছে। ঘূর্ণয়নের পরিমান টা এত বেশি হবার কারণে এখানে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট এর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সেই বিদ্যুৎ সরাসরি চলে যায় ট্রান্সফরমার এ। ট্রান্সফরমার এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ টাকে পৌঁছে দেয়া হয় আপনার আমার বাড়িঘর, ইন্ডাস্ট্রি, অফিস, কলকারখানা এমন যেকোন জায়গায়। সো আপনি অলরেডি জেনে গেছেন পরমাণু বিদ্যুৎ কি, কিভাবে কাজ করে এবং কিভাবে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আগামী ২০২৩ এবং ২৪ সালের মধ্যে দুটি পরমাণু চুল্লি চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাশিয়ান রোসাটমের সহযোগিতায় যা খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণ গোটা একটা এলাকা ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। আবার পারমাণবিক যে বর্জ্য রয়েছে তা ১০০০০ বছর পর্যন্ত একটিভ থাকতে পারে।