হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের সকলেরই একটি অতি পরিচিত একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং মেসেজিং অ্যাপ। ফ্রি মেসেজিং এবং কানেকটিভিটির জন্য বিশ্বব্যাপী হোয়াটসঅ্যাপ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমাদের মনে প্রায়ই আসে তা হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপের ইনকামের উৎস কী? অন্যান্য ফ্রি অ্যাপে গুলো মতো এ অ্যাপে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কিংবা ইনঅ্যাপ প্যাসচেজ এর ব্যবস্থা নেই। তাহলে এই অ্যাপটি কীভাবে তার বিপুল ব্যায় বহন করে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে হোয়াটসঅ্যাপে এবং এর বর্তমান প্যারেন্ট কোম্পানি মেটার একটি অন্ধকার অধ্যায় সামনে চলে আসে। আপনারা কি জানেন মেয়টা কি ? এতদিন আপনারা সবাই যাকে ফেসবুক নাম চিনতেন তারাই তাদের নাম পরিবর্তন করে মেটা রেখেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্দিষ্ট কোন ইনকাম সোর্স ছাড়াই কীভাবে হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের সবার পরিচিত অনলাইন প্লাটফর্ম মেটা ইকোসিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এবং এর আয়ের প্রধান উৎসটা কী?
২০০৯ সালে জ্যান কউম এবং তার বন্ধু ব্রায়ান একটন মিলে একটি ইউজার ফ্রেন্ডলি আ্যড ফ্রি কমিনিকেশন প্লাটফর্ম তৈরি চিন্তা ভাবনা করেন। যেখানে থেকে তারা হোয়াটসঅ্যাপ তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হন। অ্যাপটি প্রাথমিক ভাবে শুধুমাত্র স্ট্যাটাস দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও শীঘ্রই এতে প্রাইভেট মেসেজিং সার্ভিস চালু হয়।যা দ্রুতই গ্রাহকদের মাঝে হোয়াটসঅ্যাপেকে জনপ্রিয় করে তোলে। ২০১০ সালে আইএস এর পাশাপাশি তাদের অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ রিলিজ করার পরবর্তী দুই বছরের ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তাদের এক্টিভ ইউজার সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মধ্যে এর সংখ্যা বেড়ে চারশো মিলিয়নে উন্নি হয়। যেকোনো ফ্রী অ্যাপ সাধারণত অ্যাডভাটাইজিং, ইনঅ্যাপ প্যাসচেজ কিংবা ডেটা সেল এই তিনটি উপায়ে যেকোন একটি ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে থাকে। হোয়াটসঅ্যাপের প্রতিষ্ঠাতারা অ্যাডভাটাইজিং বিরোধী ছিলেন এবং এবং এই কারণে তারা ইয়াহু এর চাকরি ছেড়ে হোয়াটসঅ্যাপ তৈরি করেছিলেন। একই সাথে তারা ইনঅ্যাপ প্যাসচেজ সার্ভিসটিও খুব একটা পছন্দ করতেন না।তারা তাদের গ্রাহকদের প্রাইভেসি রক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন।
প্রথম দিকে তারা তাদের ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট অর্থ ব্যয় করে হোয়াটসঅ্যাপের ফান্ডিং করেন এবং পরবর্তীতে থার্ড পার্টে ইনভেসমেন্ট এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।কিন্তু দিনে দিনে হোয়াটসঅ্যাপের ইউজার বাড়তে থাকায় তারা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া জায়েন্টদের নজরে পড়ে যায়। ২০১৪ সালে গুগলের সাথে আলোচনা চলাকালে মেটার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ১৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিময় হোয়াটসঅ্যাপকে কিনে নেন। উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালে হোয়াটসঅ্যাপ এক বিলিয়নেরও বেশি ইউজার ছিল এবং গত কয়েক বছর ধরে এই ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মের ইউজার য়সংখ্যা ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছে। যা ফেসবুক কিংবা বর্তমান মেটার অন্য দুইটি মেসেজিং অ্যাপ মেসেঞ্জার এবং ইনস্টাগ্রাম থেকেও অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন জাকারবার্গ অ্যাপটিকে এই বিশাল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে কিনে নিলেন?তাদের কাছে ইতিমধ্যে মেসেঞ্জার এবং ইনস্টাগ্রামের মতো লাভজনক অ্যাপের মালিকানা ছিল। অন্যদিকে হোয়াট্সঅ্যাপের এমন কোন ইনকাম তো ছিলই না বরং প্রতিবছর তাদের আর্থিক ক্ষতি পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। আর এখানেই শুরু হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপকে ঘিরে মেটার একটি অজানা অন্ধকার অধ্যায়।
মনে রাখবেন "If you aren't paying for the product then you are the product." হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেওয়ার পিছনে মেটার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত হোয়াটসঅ্যাপের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে মেটার নিজস্ব ম্যাসেজিং প্লাটফর্ম মেসেঞ্জার দিনে দিনে পিছিয়ে পড়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয়ার মাধ্যমে মেটা শুধু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমিয়ে রাখেনি বরং এর মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রাহককে তাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেমে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত হোয়াটসঅ্যাপের মালিকানা অর্জনের মাধ্যমে মেটার বিপুল সংখ্যক গ্রাহকদের পার্সোনাল ডেটা নিজেদের দখলে আনতে পারে। মেটা এবং অন্যান্য যেসকল প্ল্যাটফর্ম আছে তাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু গ্লোবাল কানেক্টিভিটি নয় । তারা তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রাহকদের পার্সোনাল ডাটা কে টার্গেট করে নিজস্ব অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পুঁজিবাদী মার্কেটে বিস্তার ঘটায়। আপনারা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন আপনাদের যদি কোন পণ্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা হঠাৎ করেই আপনার ফেইসবুক নিউজফিডে ঠিক সেই পণ্যের বিজ্ঞাপন আসা শুরু হয়।
ঘটনাটি কিন্তু মোটেও কাকতালীয় নয়। আপনার ইউজার ডেটা এনালাইসিস এর মাধ্যমে মেটা এই কাজটি করে থাকে। তাহলে বুঝতেই পারছেন ইউজার ডেটা মেটার কাছে ঠিক কতটা মূল্যবান। মেটাকে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সার্ভেলেন্স বেইজড কম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেটা যে যত বেশি ইউটিউবে ডেটা কালেক্ট করতে পারবে মার্কেটে তারা তাদের প্রতিযোগীদের থেকে ততটাই এগিয়ে থাকতে পারবে। মেটা তাদের গ্রাহকদের থেকে বিভিন্ন ধরনের ডেটা কালেক্ট করতে পারলেও কিছু বিশেষ মেটা তারা তাদের নিজস্ব সিস্টেম থেকে গ্রহণ করতে পারত না। হোয়াটসঅ্যাপ তাদেরকে সেই যেটা গুলি হাতে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রাহক থেকে বিহেবিরিয়াল ডেটা , কন্টর্টাক্ট ডাটাসহ আরো অনেক ধরনের ডাটা সাপ্লাই দিতে পারে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রাহক থেকে প্রাপ্ত কন্টর্টাক্টার নাম্বারে মাধ্যমে মেটা অনলাইন এবং অফলাইন ওয়ার্ল্ড এর মধ্যে প্রথমবারের মতো সমন্বয় ঘটাতে সফল হয়।
অতীতে হোয়াটসঅ্যাপের ১ ডলার সাবস্ক্রিপশন ফি থাকলেও মেটা বর্তমানে গ্রাহকদের আরো বেশি করে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ফি বাতিল করে হোয়াট্সঅ্যাপকে সম্পূর্ণ ফ্রী করে দিয়েছে। এই এক ডলার ফি চাইতে ইউজার ডাটা মেটার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । ফোর্বসের সমীক্ষা অনুযায়ী হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন থেকে শুরু করে ২০ বিলিয়ন ডলার উপার্জনে সক্ষমতা আছে। তাহলে কেন মেটা হোয়াটসঅ্যাপ থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের সুযোগ নিচ্ছে না? এর উত্তর হচ্ছে এই নগদ অর্থের থেকে মেটার কাছে ইউজার ডাটা কালেকশন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিরুদ্ধে ইউজারদের প্রাইভেসি লংঘন করার অভিযোগ অনেক আগে থেকেই রয়েছে। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিক্যাল মেটার বিরুদ্ধে বেশ আগে থেকেই এ ব্যাপারে অভিযোগ করে আসছে । এর পাশাপাশি এটাও শোনা যায় যে তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে প্রায়ই ইউজার ডেটা বিক্রি করে থাকে।
এই অভিযোগগুলি যদি কিছুটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বুঝতেই পারছেন গ্রাহকদের কাছ থেকে সাবস্ক্রিপশন ফি গ্রহণ করার চাইতে মেটা কেন হোয়াটসঅ্যাপে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানো প্রতি বেশি জোর দিচ্ছে। তবে ইদানিং মেটা হোয়াটসঅ্যাপ বিজনেস নামে নতুন একটি সেবা চালু করেছে। যেখান থেকে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারছে। এছাড়াও ভারত ও ব্রাজিলের তারা সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে পে নামক একটি অনলাইন মানি ট্রান্সফার সিস্টেম পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু করেছে যা থেকেও কিছু আয় হচ্ছে। হোয়াট্সঅ্যাপ এখন দিনে দিনে তাদের ইউজার সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এই প্লাটফর্মে অনেক সম্ভাবনা এবং মেটা এখনও এই অ্যাপকে ঘিরে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এখনও হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সরাসরি ইনকাম করছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতেও তারাই সার্ভিসটিকে ফ্রি রাখবে।