ইন্টারনেট জগতের এক বিষ্ময়কর আবিষ্কার ব্লকচেইন। বিটকয়েনের মত অসংখ্য ক্রিপ্টোকারেন্সির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি। অনেকই বলেন, ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবন হল ব্লকচেইন। বৈপ্লবিক এই প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যৎকে নতুন করে নির্মান করতে যাচ্ছে। ব্লক চেইন প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে; একই সাথে ইন্টারনেট পরিসেবাগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করছে।
ব্লকচেইন হল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ধারণা। এই ধারণার মূল কথা হলো কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যাবে না। অথচ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। কেউ আমাদেরকে টাকা দিলে আমরা বিশ্বাস করি এটি জাল টাকা নয়। বাজার থেকে খাবার কেনার সময় মনে মনে বিশ্বাস রাখি খাবারটি ভেজাল নয়। কিন্তু বাস্তবে সবকিছু এত সহজে বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাজারে অসংখ্য জাল নোট আছে, সেই সাথে ভেজাল খাবারের বাজার সয়লাব। এরকমভাবে বিশ্বের অসংখ্য দুর্নীতিতে ভরা ব্যাংক আছে, যারা মোটেও বিশ্বস্ত নয়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের বিশ্বাস ভঙ্গ করে গ্রাহকের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে।
ব্লকচেইন |
তেমনই ঘটনা ঘটেছিল দুই হাজার সাত আট সালের অর্থনৈতিক মন্দায়। সেই মন্দর পরে সাতোশি নাকামোতো নামে এক কাল্পনিক চরিত্র পৃথিবীর বহু পুরনো অন্ধবিশ্বাস প্রথা বাতিল করে, নতুন এক ব্যবস্থার জন্ম দেয় একে বলা হয় ব্লকচেইন। ব্লকচেইন ব্যবস্থায় কোন একক ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করে তাদের কাছে আপনার টাকা বা তথ্য গচ্ছিত রাখতে হবে না। একজন দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পরিবর্তন করে। টাকা গায়েব করতে পারলেও ব্লকচেইন তা সম্ভব নয়। কারণ এখানে সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে। বিশাল কোন তথ্য ব্যাবস্থা সবাই মিলে ছোট ছোট অংশের নিয়ন্ত্রণ করাই হলো ব্লকচেইন । ব্লকচেইনে যে বিষয়টি সবচেয়ে ভালো তা হলো কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তথ্যের আদান-প্রদান সফলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। ব্লকচেইন ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকের মতো মধ্যস্বত্বভোগীদেরকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব । এর ফলে বিশ্বে অর্থনীতি গুটিকতক কোম্পানির দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ শতাংশ জিডিপি ব্লকচেইন অধীনে চলে আসবে।
ব্লকচেইন হল তথ্য সংরক্ষণের সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি। একটি ব্লক হলো কোনো একটি বিষয়ের সামান্য কিছু তথ্য। একাধিক ব্লক একটির সাথে আরেকটি জোড়া লেগে তৈরি হয় ব্লকচেইন। মনে করুন আপনার কাছে চারটি কয়েন আছে, সেখান থেকে আপনি একটি কয়েন খরচ করলেন। তাহলে একটি নতুন ব্লক তৈরি হবে এবং নতুন ব্লকটি প্রথম সাথে সংযুক্ত থাকবে। তখন প্রথম ব্লকটি লক হয়ে যাবে। এভাবে আপনি নতুন আয় করলে বা খরচ করলে নতুন নতুন ব্লক তৈরি হবে। আর আগের ব্লকটি লক হয়ে যাবে । তার মানে আগে তথ্য পরিবর্তন করা যাবে না।কারণ এসব ব্লক খোলা যায় না এবং লিংক গুলোও ভাঙা যায় না। ভীষণ কঠিন কোড দিয়ে তৈরি এই লিংক দিয়ে করা হয়েছে। সে কারণেই ব্লকচেইনে থাকা তথ্য গুলো নিরাপদ এবং বিশ্বাসযোগ্য।
ব্লকচেইনে টাকার হিসেবকে বলা হয় লেজার। ব্লকচেইনের লেজার ব্যাংকের মতো একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে না। ব্লকচেইন লেজারের কপি লক্ষ-লক্ষ ব্যক্তিগত কম্পিউটারে হুবহু সংরক্ষিত থাকে। ব্লকচেইনে থাকা সকল কম্পিউটারে সংযোগকে বলা হয় ডিসেন্ত্রালাইজড নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে সংরক্ষিত টাকার হিসেব কে বলা হয় ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার। প্রতিটি নতুন ব্লক যুক্ত হবার সাথে সাথে নেটওয়ার্কে থাকা সবগুলো কম্পিউটারের তথ্য আপডেট হয়ে যায়। শুধু তাই নয় এই নেটওয়ার্কে থাকা সব গুলো লেজারের কপি একটি আরেকটির সাথে সংযুক্ত। কেউ যদি ব্লকচেইনে থাকা তথ্য পরিবর্তন করতে চায় তাহলে তাকে নেটওয়ার্কে থাকা সকল কম্পিউটারের তথ্য গুলো অনবরত পরিবর্তন করতে হবে। কারণ প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন ব্লক তৈরি হচ্ছে। ভীষণ কঠিন কোড গুলো ভেঙে তথ্য পরিবর্তন করা শুধু কঠিনই নয় অসম্ভবের কাছাকাছি। ব্লকচেইনে থাকা তথ্য একই সাথে সুরক্ষিত এবং স্বচ্ছ । কারণ পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে যে কেউ এই হিসেব দেখতে পারে এবং কোন কিছু গড়বড় হতে দেখলে যে কেউ তার প্রতিবাদ করতে পারবে।
আরও পড়ুন - বিটকয়েন কি ?
ব্লকচেইন প্রযুক্তি শুধু আর্থিক লেনদেনের সাথে সম্পর্কিত নয়। বিশ্ব বাণিজ্য, মেডিকেল রেকর্ড, খাদ্যনিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবহন সেক্টর সহ বহু খাতে ব্লকচেইন সফল ভাবে ব্যবহার করা যাবে। ফেসবুক, গুগলের মত বড় বড় প্রতিষ্ঠান কাছে আমরা আমাদের মূল্যবান তথ্য গচ্ছিত রাখি। সেই সাথে বিশ্বাস করি তারা আমাদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য তারা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেজন্য ব্লক ভিত্তিক বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং চ্যাটিং অ্যাপস গড়ে উঠেছে যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। ব্লকচেইনে থাকা তথ্য যেহেতু পরিবর্তন করা যায় না, তাই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব। যাতে কেউ নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি করতে না পারে। নতুন এই প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিতরা বলছে ব্লকচেইনের মাধ্যমে আমাদের অর্থ হবে আরো সুরক্ষিত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা হবে দুর্নীতিমুক্ত এবং আমাদের অনলাইন কার্যক্রম হবে তৃতীয় পক্ষের নজরদারি মুক্ত। তবে সকল ক্ষেত্রে ব্লকচেইন এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে যে সফটওয়্যার দিয়ে ব্লকচেইন লেখা হবে সেটি হতে হবে নির্ভুল। কিন্তু বাস্তবতা হলো শতভাগ নির্ভুল সফটওয়্যার তৈরি করা কখনও সম্ভব হয়নি। সামান্য একটি কোডের ভুলের কারণে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে একে বলা হয় ক্যাশলস ওয়ালস প্রবলেম। কোন দুর্গের দেয়াল যতই উঁচু হোক না কেন তার দরজা যদি উঁচু হয় তাহলে প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় না। ব্লকচেইন নিয়ে অনেকে আশা নিরাশা দোলাচলে থাকলেও প্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বাঁচতে হলে ব্লকচেইন প্রযুক্তির বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন - ক্রিপ্টোকারেন্সির কি ?