মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন যুগের যাত্রা শুরু হচ্ছে। ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীক্ষন যন্ত্র যার নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরে কি আছে এবং সেখানে কি ঘটছে তা দেখার চেষ্টা করা হবে এই টেলিস্কোপ এর সাহায্যে। দীর্ঘ ৩০ বছরের চেষ্টায় এই দূরবীক্ষন যন্ত্র তৈরি করতে খরচ হয়েছে এক হাজার কোটি ডলার। এই যন্ত্র ব্যবহার করে ১৩৫০ কোটি বছর আগের ছবি তোলা সম্ভব হবে। সেই কারণে এই মহাকাশ দূরবীক্ষন যন্ত্রকে বলা হচ্ছে টাইম মেশিন। আজকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সর্বপ্রথম টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বমন্ডল সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছিল। তারপর প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদেরা সমগ্র মহাবিশ্ব সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে স্থাপিত দূরবীক্ষন যন্ত্র গুলোর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেগুলো যথেষ্ট তথ্য দিতে পারছিল না। তাই বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে একটি টেলিস্কোপ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। প্রথম মহাকাশ দূরবীক্ষন যন্ত্র পৃথিবীর বাইরে পাঠানো হয় ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল যার নাম হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপটি মহাকাশে কাজ শুরু করার পর থেকে জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যয়ন এবং ইতিহাস সম্পূর্ণই বদলে গেছে। সেই হাবলেরই উত্তরসূরী হলো বর্তমান জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। এটি হাবলের চেয়েও একশো গুণ বেশি শক্তিশালী। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি নাসার দ্বিতীয় পরিচালক জেমস ই ওয়েব এর নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি এপোলো অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে অভিযানের মাধ্যমে মানুষ চাঁদের বুকে পা রাখতে পেরেছিল। ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অতি সংবেদনশীল এই যন্ত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪ টি দেশের ৩০০র ও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ |
আরিয়ান ফাইভ রকেটের মাধ্যমে ফ্রেঞ্চ গায়ানা মহাকাশ স্টেশন থেকে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে স্থাপিত হবে। পৃথিবী থেকে এতদুরে মহাকাশের তাপমাত্রা মাইনাস ২৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অতি শীতল তাপমাত্রা জেমস ওয়েবের ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করবে। পৃথিবী থেকে এত দূরে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতি ঠান্ডা রাখা। পৃথিবীর কাছ দিয়ে দূরবীক্ষন টি পরিভ্রমণ করলে পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত উত্তাপের কারণে এর যন্ত্রপাতি গরম হয়ে যেতে পারে যার ফলে যন্ত্রটির অতি নিখুঁত পরিমাপে সমস্যা দেখা দিবে। মহাবিশ্বের বহুদূরের বিষয় পর্যবেক্ষণ করার জন্যে এই দূরবীক্ষন যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময় ছড়িয়ে পড়া আলো সংগ্রহ করে ছবি তুলবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এই মহাকাশ দূরবীক্ষন যন্ত্র শুধু অতীতের সন্ধানই করবে না, অতীতকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরবে। সে কারণে একে বলা হচ্ছে টাইম মেশিন। জেমস ওয়েবের প্রধান দুইটি বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য হলো ছায়াপথের জন্ম ও বিবর্তন এবং গ্রহসমূহের সৃষ্টি রহস্য পর্যবেক্ষণ করা। এসব তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হলে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্বের অসংখ্য গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হবে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরে কি আছে এবং সেখানে কি ঘটছে তা দেখার চেষ্টা করা হবে এই টেলিস্কোপের সাহায্যে। জেমস ওয়েবের আরেকটি লক্ষ্য হলো বহুদূরের গ্রহগুলোর পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা যার মাধ্যমে অনুমান করা সম্ভব হবে সেগুলোতে কোনো প্রাণী বসবাসের মত পরিবেশ আছে কিনা। এছাড়া আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের আরো নিখুঁত এবং কাছের ছবি তোলা হবে জেমস টেলিস্কোপে যার মাধ্যমে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে আরো গভীর ভাবে জানা যাবে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বিশাল প্রতিফলক আয়না যা প্রায় সাড়ে একুশ ফুট চওড়া। বিশাল আকৃতির এই আয়না ১৮টি ষড়ভুজ আকৃতির আয়নার সমন্নয় এ তৈরি করা হয়েছে। এসব আয়না স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া বেরিলিয়াম ধাতু দ্বারা তৈরি। টেলিস্কোপটি এত বড় যে এই বিশাল আকারের বস্তু মহাকাশে সরাসরি পাঠানোর মতো মানুষ এখনো আবিস্কার করতে পারেনি তাই টেলিস্কোপটিকে বিশেষ ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে। সাড়ে একুশ ফুট প্রশস্ত এই টেলিস্কোপকে সাড়ে সতের ফুট রকেটের ভেতর স্থাপন করতে, একে ভাঁজ করার উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়েছে। তারপরও একে মহাকাশে পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ত রকেট। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির আরিয়ান ফাইভ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট গুলোর ভিতরেও অন্যতম। ভাঁজ করে মহাকাশে পাঠানোর জন্য মহাকাশে গিয়ে এটিকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনা এই অভিযানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। টেলিস্কোপটির ভাঁজ খুলতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। ১৭৮ টি রিলিজ মেকানিজম এর মাধ্যমে পঞ্চাশটি কলকব্জা সম্পুর্ন প্রসারিত হতে হবে। এই ধাপে কোনো একটি বিষয় কাজ না করলে সম্পূর্ণ যন্ত্রটি অর্থহীন হয়ে যাবে। এই টেলিস্কোপে ৩০০ টিরও বেশি নষ্ট হবার যন্ত্র রয়েছে এবং এই সবগুলোকে ঠিকভাবে কাজ করতে হবে। মহাকাশে উৎক্ষেপণ এর সময়ে রকেটের প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে এর অনেককিছুই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অতীতে কয়েকবার উৎক্ষেপণ এর তারিখ ঠিক হবার পরেও টেলিস্কোপ টি মহাকাশে পাঠানো যায়নি কারণ ভাঁজ করার পর যন্ত্রের ভিতর কয়েকটি বিষয় ভেঙে গিয়েছিল। প্রতিটি বিষয় ঠিক করতে চার বছর করে সময় লেগেছে। এভাবে যন্ত্রটির উৎক্ষেপণ প্রায় বার বছর পিছিয়েছে। এখনো পর্যন্ত যতগুলো মহাকাশ যান তৈরি করা হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর। মহাকাশে যাবার পরে পুরোপুরী কার্যক্ষম হতে যন্ত্রটির কয়েকমাস সময় লেগে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে এই যন্ত্র থেকে প্রথম ছবি পেতে প্রায় ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ কে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের উত্তরসূরী বলা হলেও দুটি দূরবীক্ষন সম্পুর্ন আলাদা ধরণের। অনেক বিজ্ঞানী হাবল স্পেস টেলিস্কোপ আবিস্কারকে মানুষের চাঁদে অবতরণের চেয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী আবিস্কার বলে মনে করেন। ১৯৯০ সালের ২০ মে হাবল টেলিস্কোপ তার প্রথম তোলা ছবিটি পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল। হাবল টেলিস্কোপের তোলা এই ছবিতে ৫ হাজার গ্যালাক্সি ধরা পড়েছে যা আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩.২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। এবার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বের শেষ সীমা দেখার ইচ্ছা বিজ্ঞানীদের। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাথে এর গুরুত্বপূর্ন পার্থক্য হলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপের আয়নার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় সাড়ে সাত ফুট আর জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এর আয়নার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে একুশ ফুট। হাবলের কাজ করার জন্যে বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দরকার হয় আর জেমস কাজ করবে মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এরও কম তাপমাত্রায়। হাবল টেলিস্কোপের ভর ছিল ৬২০০ কেজি আর জেমস টেলিস্কোপের ভর ১২২০০ কেজি। হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে উৎক্ষেপণ এর পর ধারণা করা হয়েছিল যন্ত্রটি পনেরো বছর কার্যক্ষম হবে। কিন্তু যন্ত্রটি পাঁচবার মেরামত ও আপডেট করার ফলে সম্ভাব্য মেয়াদেরক দ্বিগুন সময় প্রায় ৩২ বছর পার করে দূরবীক্ষন টি এখনো কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর মহাকাশ গবেষণায় কাজে আসবে। তবে এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানোর পরে একে পরিবর্তন বা মেরামত করার আর কোনো সুযোগ নেই। কারন পৃথিবী থেকে এত দূরে গিয়ে এসব যন্ত্র ঠিক করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
মহাকাশ সম্পর্কে মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষাই শুধু বাড়ছে না বরং মহাকাশে বসবাস এবং ভ্রমনের ইচ্ছাও দিন দিন তীব্র হচ্ছে। কিছুদিন আগে জাপানি বিলিয়নিয়ার ইউসাকু মায়েজাওয়া মহাকাশ স্টেশনে গেছেন। তবে তিনি কোনই গবেষণা বা বৈজ্ঞানিক কাজে সেখানে যাননি। তিনি মহাকাশে গেছেন পর্যটক হিসাবে। এই বিলিয়নিয়ার মহাকাশ স্টেশনে বেড়ানোর জন্যে খরচ করেছে ৬০০ কোটি টাকার ও বেশি। মজার ব্যাপার হলো জাপানি উবার ইটস এই বিলিয়নিয়ারকে ফুড ডেলিভারি বয় হিসেবে ব্যবহার করেছে। তিনি মহাকাশ স্টেশনে উবার ইটস এর হোম ডেলিভারী ও পৌঁছে দিয়েছেন।