টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস, টাইটানিক জাহাজ (History of the Titanic)
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল ১১ টা বেজে ৪০ মিনিটে টাইটানিক জাহাজের সাথে একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। যার ফলে টাইটানিকের প্রথম যাত্রা শেষ যাত্রাতে পরিণত হয়। টাইটানিক জাহাজ ডুবে যাওয়ার রহস্য বিজ্ঞানীরা শেষমেষ প্রকাশ করেছে।
টাইটানিক জাহাজ |
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন সবথেকে বড় জাহাজ আটলান্টিক সাগর বরফ ঠান্ডা জলে ১৫০০ টি প্রাণ নিয়ে সারা জীবনের জন্য নিয়ে যায় এবং একটি জলীয় কবরস্থান তৈরী করে। বিজ্ঞানীরা পুনরায় এই বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেই সময়ের টাইটানিক নিয়ে রহস্য ১০০ বছর চাপা পড়েছিল। সে গুলোকে আবারো পুনরায় রিসার্চ করা হয় এবং বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্যকর তথ্য।
৮০৮২ ফিট ৯ ইঞ্চি লম্বা, ৯২ ফিট চওড়া, ১৭৫ ফিট উচ্চতা এবং ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ৩২৮ টন ওজনের এই টাইটানিককে অধ্বংসাশী বলে মনে হতো। অর্থাৎ যাকে ধ্বংস করা যায় না বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। যাত্রিরা কয়েক কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন। এমনকি এই জাহাজের চালক, নেভি অফিসার এবং ক্রুদের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগেছিল জাহাজটির কোথায় কি আছে তা আয়ত্বে আনতে। এছাড়া জাহাজটির ধোয়া ছাড়ার জন্য ৪ টি চিমনি ছিল যেকোনো উচ্চতা ৮১.৫ ফুট ছিল। প্রত্যেকটির ওজন ছিল ৬০ টন। এছাড়াও এই চিমনি গুলো 30 ডিগ্রি কোণে হেলিয়ে বানানো হয়েছিল। যাতে টাইটানিককে আরো স্টাইলিশ লাগে। সেই সময় এটিকে তৈরি করতে ৭.৫ মিলিয়ন ডলার লেগেছিল। যেটার 2021 সালের মূল্য হয় ১৮০ মিলিয়ন ডলার যেটা কিনা অনেক কম টাইটানিক সিনেমা তৈরির থেকে। ১৯৯৭ সালে টাইটানিক সিনেমাটি (Titanic movie) তৈরি করতে ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল।
হারলেন ও উলফ শিপইয়ার্ড এই জাহাজটিকে তৈরি করবার জন্য ৩০০০ শ্রমিককে কাজে লাগিয়েছিল। সপ্তাহের ছয়দিন সকাল ৬:৩০ থেকে কাজ শুরু হতো এবং ২৬ মাসের মধ্যে জাহাজটির মনুমেন্টাল কাজ শেষ হয়ে যায়। এই জাহাজের কাজটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কারণটা একটু ইমাজিন করলেই বোঝা যাবে। বিনা সুরক্ষায় শ্রমিকেরা 20 তলা উঁচু বিল্ডিং এর সমান উচ্চতায় শ্রমিকরা কাজ করতো। নির্মাণ কাজ চলার সময় 8 জন শ্রমিক প্রাণ হারায় ও ৪২৮ জন শ্রমিক আহত হন। এত পরিশ্রম এত ত্যাগের বিনিময়ে বানানো টাইটানিক জাহাজ একটি বরফের কারণে ডুবে গেল???
জার্নালিস্ট সোলাম মোলনিক ৩০ ধরে টাইটানিকের সাথে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। তিনিই প্রথম টাইটানিক এর কিছু ছবি থেকে ৩০ ফুট এর কালো দাগ লক্ষ্য করেছিলেন। টাইটানিক জাহাজ কে ছাড়বার আগে কিছু ছবি থেকে এবং টাইটানিক তৈরির সময় এর কিছু ছবি থেকে এই স্পর্ট তিনি চিহ্নিত করেছেন। এই স্পর্টি ছিল জাহাজের ডেকের নিচের অংশে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এত বড় একটি স্পট কেন কেউ লক্ষ্য করেনি।
এর কারণ জাহাজটির মুখ সমুদ্রের দিকে ছিল এবং পেছনের দিকটা ডকের দিকে ছিল এবং ওই দিক থেকে যাত্রী এবং বাকি সকলে ওঠা-নামা করবে। জাহাজটি অনেক লম্বা হওয়ায় কেউই সামনের স্পটটি পেছন থেকে লক্ষ্য করতে পারেনি। টাইটানিক এর যাত্রা শুরু করবার আগেই তিন সপ্তাহ ধরে জাহাজের এই কালো স্পট অংশটিতে আগুন ধরেছিল। তিন সপ্তাহ ধরে একটানা সেখানে আগুন জ্বলতে থাকে। যার কারণে সেখানকার ধাতুগুলো উচ্চতাপে গলতে শুরু করে। এর কারণে জাহাজটি অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বরফের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় এই পরিণতি হয়। এতবড় একটি জাহাজের ছোট্ট একটা ফুটো থাকলে কি চুরি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই যে বরফখণ্ড সেই আগুন লাগা অংশে আঘাত করে এবং সব শেষ হয়ে যায়।
জাহাজ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এই আগুনের কথা আগে থেকেই জানতো এটাও জানত যে এরকম অবস্থায় সমুদ্রযাত্রার ফল কি রকম হতে পারে। জাহাজ কোম্পানির মালিকরা আগে থেকেই ব্যাংকের কাছ থেকে অনেক ঋণ নিয়েছিল এবং জাহাজটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও ওইদিনের সব জাহাজকে ক্যানসেল করা হয়েছিল কারণ সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজের প্রথম যাত্রী হতে চেয়েছিল।
আরও পড়ুন : পানির নিচে খুঁজে পাওয়া আশ্চর্যজনক আবিষ্কার
টাইটানিক এর ভেতরে হোটেলটা অনেক বিলাসবহুল করা হয়। বিশাল ঘুর্ণয়মান সিঁড়ি দিয়ে জাহাজের দশ তলার মধ্যে সাত তলাকে যুক্ত করে। এই জাহাজটি সুসজ্জিত ছিল বিভিন্ন পেইন্টিং, স্ট্যাচু এবং কাঠের পেনেল দ্বারা।
প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ছিল। যেমন গরম জলের সুইমিং পুল, টেনিস খেলার কোট, একটি বিউটি সেলুন। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য খাবারের মধ্যে ১৩ রকমের ধরন ছিল। প্রত্যেকটি খাবারের সঙ্গে আলাদা আলাদা ধরণের ওয়াইন দেয়া হতো। জাহাজে পনেরশো বোতল ওয়াইন 20 হাজার বোতল বিয়ার এবং ৮ হাজার সিগারেট নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা দূরবীন নেয়া হয়েছিল না। একটিমাত্র দূরবীন টাইটানিক কে বাঁচাতে পারত, কারণ একটি দূরবীন দিয়ে দূরে বরফখণ্ড কে দেখা যেত এবং জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করা যেত।
এছাড়াও জাহাজের চালক জাহাজটি অনেক গতিতে চালাচ্ছিল। কারণ সে জানত এত বড় জাহাজ কোন কিছুতেই কিছু হবে না। কিন্তু যখন সে বরফখণ্ড টিকে লক্ষ করে তখন জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। জাহাজটিতে আরো কম সংখ্যক লাইফবোট ছিল, জাহাজটির স্টাইল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে জাহাজে কম সংখ্যক লাইভ বোর্ড রাখা হয়।
এছাড়াও জাহাজটি যখন ডুবতে শুরু করে তখন জাহাজের ক্রু মেম্বাররা সাহায্যের জন্য বাজির সাহায্যে সিগন্যাল পাঠাতে থাকে। কিছুদূর দূরে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া নামের জাহাজটির ক্যাপ্টেন ওই সিগন্যাল উপেক্ষা করে। এরপর যখন এই ঘটনাটি সামনে আসে তখন ওই ক্যাপ্টেন কে সাসপেন্ড করে দেয়া হয়। কারণ সেদিন যদি তিনি সাহায্য করতে যেতেন তাহলে এতগুলো প্রাণ সাগরের হারিয়ে যেত না।